একটি অপূর্ণ বিদায়: স্মৃতির মণিকোঠায় বন্ধু সুমন
জীবনে কিছু সম্পর্ক এমন হয়, যা সময়ের স্রোতে ভেসে গেলেও তার গভীরতা একটুও কমে না। আমার বন্ধু গোলাম হোসেন সুমনের স্মৃতি আমার কাছে তেমনই। উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে বিমান দুর্ঘটনার পর এক বন্ধুর মুখে যখন শুনলাম, "আমি জানতাম তুমি আসবে," এটা দেখেই আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল সুমনের মুখ, আর তার সাথে জড়িত একটি অপূর্ণ গল্পের অধ্যায়।
২০১৯ সালের ৩রা জানুয়ারি। তার ঠিক আগের রাতটা ছিল আমাদের বন্ধুদের এক অবিস্মরণীয় আনন্দ-উৎসব। এক বন্ধুর গায়ে হলুদে আমরা সবাই মেতে উঠেছিলাম। বরযাত্রী সেজে মোটরসাইকেলে চড়ে বরের বাড়ি থেকে কনের বাড়িতে যাওয়া, সেই উন্মাদনা এখনো আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল। হাসি-ঠাট্টা আর অফুরন্ত আড্ডার পর সবাই যে যার বাড়িতে ফিরলাম। পরের দিন ছিল বিয়ের মূল অনুষ্ঠান, শুক্রবার।
আমরা সবাই প্রস্তুত হচ্ছিলাম বিয়েতে যাওয়ার জন্য। সুমন বরের গাড়ি সাজিয়ে প্রস্তুত হয়ে আমাকে নিতে আমার বাসায় এসেছিল। আমি তৈরি ছিলাম, কিন্তু হঠাৎই কেন জানি আমার মন সায় দিচ্ছিল না। "আমি পরে যাবো," বলে সবাইকে বারবার ফেরাচ্ছিলাম। সুমন আর ইমরান আমাকে অনেক বোঝাল, "চমক, এখনই চল, এক সাথে যাই!" আমি নাছোড়বান্দা। সুমন আমার মাকে পর্যন্ত অনুরোধ করল, "কাকি, ওকে বলেন না এখনই যেতে!" কিন্তু আমার কেন জানি একগুঁয়ে মন সেদিন তার কথা শুনল না।
অনেক বলার পর, সুমন ইমরান ও সাগরকে নিয়ে বিয়ের বাড়ির দিকে রওনা দিল। সে চলে যেতেই আমার মুখে অদ্ভুত এক কথা বেরিয়ে এল, "দেখছো মা, আজকে সুমনকে কী সুন্দর লাগছে! বরের চেয়েও বেশি! মনে হচ্ছে ও নিজেই আজ বর।" এই কথা বলেই আমি আমার মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, ওদের চমকে দেব বলে।
বাজারে গিয়ে মোটরসাইকেলে তেল ভরে যেই ফোনটা হাতে নিয়েছি, অমনি সাগরের উদ্বিগ্ন কণ্ঠ ভেসে এল, "চমক, তুমি কই? সুমন এক্সিডেন্ট করেছে!" আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। বিশ্বাস হচ্ছিল না। মনে হলো, হয়তো আমি যাইনি বলে ওরা আমাকে নিয়ে মজা করছে। রাগে বললাম, "এইসব নিয়ে মিথ্যা বলো না!" সাগরও রেগে গিয়ে বলল, "মিথ্যা নয়! সুমনের বাসায় ফোন করো। আমরা ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি।"
আমার হাত কাপছিল। সুমনের বাসায় ফোন দিলাম, কিন্তু আমার গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোল না। দ্রুত মোটরসাইকেল নিয়ে হাসপাতালের দিকে ছুটলাম। রাস্তাটা যেন শেষই হচ্ছিল না। অবশেষে যখন পৌঁছলাম, দেখি আমার প্রিয় বন্ধুটি হাসপাতালের বারান্দায় নিথর শুয়ে আছে। আমি আর্তনাদ করে উঠলাম, "আমার বন্ধুটাকে দেখেন! ওর চিকিৎসা করেন!" ডাক্তার নীরবে আমার আরেক বন্ধুর চিকিৎসা করছে। পাশে দাড়িয়ে সাগর শুধু ফিসফিস করে বলল, "সুমন আর নেই।"
সেইদিন আমার বন্ধুটা আমার সাথে অভিমান করে চলে গেল, একটা কথাও বলল না। একটিবারও সুযোগ পেলাম না ওর মুখ থেকে শুনতে, "আমি জানতাম তুমি আসবে।" সেই বিদায় ছিল বড় অপূর্ণ। আমার একটি প্রার্থনা, আল্লাহ আমার বন্ধু গোলাম হোসেন সুমনকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুক। আর আমার মৃত্যুর পর যেন ওর সাথে দেখা করে বলতে পারি, "আমি এসেছিলাম বন্ধু, তুমি কথা না বলেই চলে গেলে আমাদের ছেড়ে।"
লেখকঃ চমক চঞ্চল